ভারতের আমলাতন্ত্রে কমছে মানবিকতা? সিভিল সার্ভিসে বাড়ছে প্রকৌশলীদের সংখ্যা

ভারতের পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা ইউপিএসসি-এর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রকৌশলী ও টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এবং সাফল্যের হার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতা এখন শুধু একটি পরিসংখ্যানগত পরিবর্তন নয়, এটি ভারতের শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি নিয়ে গভীর আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এই বিষয়টি সামনে এনেছে, যেখানে সতর্ক করা হয়েছে যে, এই পরিবর্তন দেশটির আমলাতন্ত্রে বৈচিত্র্য এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি হারানোর ঝুঁকি তৈরি করছে।

একসময় ভারতের সিভিল সার্ভিসে মানবিক বিভাগের স্নাতকদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলো থেকে আসা প্রার্থীরাই আমলাতন্ত্রের মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতেন। কিন্তু আজকের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখনকার সফল প্রার্থীদের অধিকাংশই প্রকৌশল বা টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসছেন। পার্লামেন্টারি কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে সফল প্রার্থীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ছিলেন প্রকৌশলী। এর বিপরীতে, একই সময়ে মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের হার ২৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশক আগের তুলনায় কম।

কেন প্রকৌশলীরা এগিয়ে আছেন? এই পরিবর্তনের পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:

১. পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন: ২০১১ সালে ইউপিএসসির সিভিল সার্ভিস অ্যাপটিচিউড টেস্ট (CSAT) চালু হওয়ার পর পরীক্ষার ধরন পুরোপুরি পাল্টে যায়। এই পরীক্ষায় যুক্তি, গণিত ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা যাচাই করা হয়, যা প্রকৌশলীদের স্বাভাবিক দক্ষতার সঙ্গে মিলে যায়। ফলে মানবিক বিভাগের প্রার্থীদের সাফল্যের হার কমে যায় এবং প্রকৌশলীদের সাফল্য বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ শতাংশে।

২. ঐচ্ছিক বিষয়ে বহুমুখিতা: অনেক প্রকৌশলী তাদের ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে প্রকৌশল না বেছে বরং রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান বা ভূগোলের মতো মানবিক বিষয়গুলো বেছে নেন। তাঁদের বিশ্লেষণাত্মক প্রশিক্ষণের কারণে তারা এসব বিষয় দ্রুত আয়ত্ত করে নিতে পারেন, যেখানে ভালো নম্বর তোলার সুযোগ থাকে।

কেন প্রকৌশলীরা নিজ ক্ষেত্র ছাড়ছেন? অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, কেন মেধাবী প্রকৌশলীরা নিজেদের উচ্চ-চাহিদাসম্পন্ন পেশা ছেড়ে সিভিল সার্ভিসে আসছেন? এর কারণগুলো হলো:

  • সামাজিক মর্যাদা: ভারতে সিভিল সার্ভিসকে সমাজের চূড়ান্ত সাফল্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
  • ক্ষমতা ও প্রভাব: জনপ্রশাসনে কাজ করার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষমতা ও প্রভাবের আশা থাকে।
  • চাকরির নিরাপত্তা: ব্যক্তিগত খাতের তুলনায় সরকারি চাকরির নিরাপত্তা অনেক বেশি।

দুশ্চিন্তার কারণ আসলে কী? ভারতের পার্লামেন্টারি কমিটির মতে, এই প্রবণতা কয়েকটি গুরুতর ঝুঁকির জন্ম দিচ্ছে:

  • বৈচিত্র্য হারাচ্ছে আমলাতন্ত্র: মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সহানুভূতি এবং সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক্ষমতা নিয়ে আসেন, যা জনপ্রশাসনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই বৈচিত্র্য কমে যাওয়ায় নীতি-নির্ধারণে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হতে পারে।
  • গুরুত্বপূর্ণ খাতে মেধাবী পেশাজীবীর অভাব: সিভিল সার্ভিসের প্রতি ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত থেকে সেরা পেশাজীবীদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক পটভূমি ও প্রস্তাবিত সমাধান বিশ্বব্যাপী অনেক উন্নত দেশে, বিশেষত ইউরোপ ও চীনে, সিভিল সার্ভেন্ট তৈরিতে মানবিক ও লিবারেল আর্টসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ এই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিতরা জনসাধারণের সঙ্গে নীতির সংযোগ ঘটাতে এবং সামাজিক পটভূমি ব্যাখ্যা করতে পারদর্শী।

এই পরিপ্রেক্ষিতে, ভারতের পার্লামেন্টারি কমিটি কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছে:

  • CSAT-এর কাঠামো পুনর্বিবেচনা: পরীক্ষার পদ্ধতি এমনভাবে তৈরি করা, যাতে এটি টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রার্থীদের প্রতি পক্ষপাতমূলক না হয়।
  • সমন্বিত নিয়োগ উৎসাহিত করা: বিভিন্ন শিক্ষাপ্রবাহ থেকে সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

ভারতের সিভিল সার্ভিসে প্রকৌশলীদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য নিঃসন্দেহে প্রশাসনকে আরও বিশ্লেষণমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর করেছে। কিন্তু এটি একই সঙ্গে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, বৈচিত্র্যপূর্ণ মতামত এবং আন্তঃবিষয়ক সমন্বয়কে দুর্বল করছে, যা কার্যকর প্রশাসনের জন্য অপরিহার্য। শাসনব্যবস্থা শুধু কার্যকারিতার বিষয় নয়, এটি সামাজিক ন্যায়, সমতা ও দূরদর্শিতারও বিষয়। তাই, ভারসাম্যপূর্ণ একটি আমলাতন্ত্রের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাগত পটভূমির সমন্বয় নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুনHSC পরীক্ষা শেষ? চট্টগ্রামে ৩ মাসের সরকারি প্রশিক্ষণ নিন, সাথে দৈনিক ১৫০ টাকা বৃত্তি!

Leave a Comment